
মো: জাহিদুল ইসলাম,
ডিমলা (নীলফামারী) প্রতিনিধি।
দেশের উত্তরাঞ্চলের ‘জীবন রেখা’ বলে পরিচিত তিস্তা নদী ডিসেম্বরেই শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে। প্রশস্ত ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ-এর সেই নদী আর নেই। সরু আকারে পরিণত হচ্ছে নদী। শুষ্ক মৌসুমের আগেই তিস্তার পেটে জেগে উঠেছে ছোট-বড় অসংখ্য চর। প্রতিবছর সময়-অসময়ের বন্যায় পলির কারণে পানির ধারণক্ষমতা কমে গেছে। অনেক স্থানে হেঁটে নদী পারাপার হন স্থানীয়রা। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, প্রতিবছর বন্যার সময় উজান থেকে দুই কোটি টনের বেশি পলি আনছে তিস্তা নদী।
এদিকে সেচ নির্ভর ইরি বোরো মৌসুমে ধান আবাদের জন্য নীলফামারীর ডালিয়ায় অবস্থিত দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ নতুন বছরের ১৫ জানুয়ারি হতে সেচ প্রদানের প্রস্তুতি নিয়েছে। কিন্তু দিন দিন যে হারে তিস্তা নদী শুকিয়ে যাচ্ছে তাতে নদীর নাব্য সংকটে সেচ কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তিস্তা অববাহিকায় শুধু কৃষিই নয়, নদী শুকিয়ে গেলে বিলীন হয় মাছের অভয়াশ্রম, বন্ধ হয়ে যায় নদী-নির্ভর যোগাযোগব্যবস্থা। এতে জেলে, মাঝিসহ লাখো মানুষের জীবন-জীবিকা চরম সংকটে পড়ে। বর্ষাকালে পানির স্রোত, শুষ্ক মৌসুমে বালু ছাড়া কিছুই থাকে না। পানি না থাকায় ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসল আবাদে নলকূপ বসিয়ে সেচ দিতে হয় কৃষকদের।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে তিস্তা নদীর অববাহিকায় বিভিন্ন চরাঞ্চলে প্রতিবছর ভুট্টা, মরিচ, পিঁয়াজ, রসুন, কুমড়া, বাদাম, আলু, গম, তিসি, সূর্যমুখী ও পাট চাষ হয়। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানি না থাকা, আর বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে কৃষকদের। বুধবার বাপাউবো উত্তরাঞ্চলের প্রধান সম্প্রসারণ কর্মকর্তা অমলেশ চন্দ্র রায় জানান, আসন্ন ইরি-বোরো মৌসুমে তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৫৭ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। যাতে ২০২৬ সালের ১৫ জানুয়ারি হতে নীলফামারীর ডিমলায়, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ, সৈয়দপুর উপজেলা, নীলফামারী সদর, রংপুর, তারাগঞ্জ, গঙ্গাচরা উপজেলা ও দিনাজপুরের খানসামা ও চিরিরবন্দর উপজেলা সেচ পাবে। এজন্য তিস্তা ব্যারাজের সেচ খালগুলো সংস্কার করা হচ্ছে।
তিস্তাপাড়ের বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন বলেন, আগোত নদী ম্যালা গভীর ছিল। বড় বড় নৌকা যাতায়াত করছিল। এ্যালা তো তেমন গভীরতা নাই। শুকানের দিনোত মানুষ হাঁটি নদী পার হয়। নদী পার হয়া ঘোড়া গাড়িত করি হামরা ফসল নিয়া যাই। ডালিয়াস্থ স্থানীয় জেলে রবিউল ইসলাম বলেন, নদীত পানি না থাকলে মাছ পাওয়া যায় না। পানির অভাবে চাষাবাদ করিয়া শান্তি নাই। আগোত আবাদ সুবাদ করছি, মাছও ধরছি। এ্যালা কোনোটায় ঠিকমতো করা হয় না। কৃষক সবুজ মিয়া বলেন, শুকনো মৌসুমে আমাদের এলাকায় পানির খুবই সংকট থাকে। এ সময় সেচ দিতে অনেক খরচ হয়। বিভিন্ন রকম অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। কৃষক মফিজুল ইসলাম বলেন, হামরা নদীপাড়ের মানুষ। বছরে বছরে থাকি উজানের ঢল আইসা বালু পড়ি পড়ি নদীর তলপেট ভরাট হইছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, তিস্তা নদী সরু হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে দেখা যাচ্ছে নদীর বুকে চর আর চর। সেখানে এ সময় পানির নাব্য কম করে হলেও ১০ হাজার কিউসেক থাকার কথা সেখানে ৩ হাজার কিউসেকে নেমেছে এবং দিন দিন নদী শুকিয়ে যাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে নদী গবেষক ও উন্নয়ন বিশ্লেষকরা বলছেন, উত্তরের পাঁচ জেলার দুই কোটি মানুষের জীবনমান রক্ষায় একমাত্র সমাধান হচ্ছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন। বাংলাদেশে তিস্তা নদীর ১১৫ কিলোমিটার পড়েছে। এর মধ্যে ৪৫ কিলোমিটার তীরভূমি ক্ষয়প্রবণ। ২০ কিলোমিটারের অবস্থা আরও গুরুতর। শুষ্ক মৌসুমে উজানের ভারতের গজলডোবা বাঁধের কারণে পানি আটকে রাখা হয়। ফলে নদী শুকিয়ে কঙ্কালসার হয়ে ওঠে, ব্যাহত হয় কৃষি, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যায় এবং গৃহস্থালিতে পানির অভাব দেখা দেয়। আন্তর্জাতিক খাদ্য নীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতে, এতে বার্ষিক ১৫ লাখ টন ধান উৎপাদন কমে। আবার বর্ষায় উন্মত্ত তিস্তা তার দুই কূল ভাসিয়ে দিয়ে লাখো মানুষকে গৃহহারা করে, যা বার্ষিক ১ লাখ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়।
নদীতে চলবে নিয়মিত নৌযান, পণ্যবোঝাই জাহাজ। সারা বছর নাব্য থাকবে তিস্তায়। কৃষকের মুখে হাসি ফুটবে। তিস্তাপাড়ের মানুষজনের এই স্বপ্ন বিজ্ঞান কল্পকাহিনির দৃশ্য নয়। এ হচ্ছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার পরের সম্ভাব্য চিত্র যা উত্তরবঙ্গকে একটি ‘গ্রিন ইকোনমিক করিডোরে’ রূপান্তরিত করবে।



