২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বাজেট দিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।সোমবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম এবং দেশের ৫৫তম বাজেট বক্তব্যে তিনি ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন। টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত ৮৮ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয় নিয়ে আমরা এগোচ্ছি। দেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতি সামলাতে মাত্র কয়েক মাস সময় পেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। দু-একটি খাতে কিছুটা স্থিতিশীলতা এসেছে। গন্তব্য তাই এখনো অনেক দূর। কঠিন কাজটি করতে সামনে আছে নানা চ্যালেঞ্জ। আর এই যাত্রাপথ এখনো দীর্ঘ। উপদেষ্টা বাজেট যেভাবে সাজালেন, তার খুব প্রশংসা করতে পারছেন না অর্থনীতিবিদ, বিশ্লেষক এবং রাজনৈতিক দলগুলো।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের মূল্যায়ন করতে হবে যে ব্যতিক্রমী সময়ের প্রেক্ষাপটে বাজেটটি প্রণীত হয়েছে তাকে বিবেচনায় রেখে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালে প্রণীত এই বাজেটের মূল দর্শন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার কথা, যে বাজেট একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি ও জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের অভীপ্সাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। বাজেটের প্রস্তাবিত কর কাঠামো, ব্যয়বিন্যাস ও উন্নয়ন কর্মসূচির অগ্রাধিকার নির্ধারণ কিভাবে করা হয়েছে, তার নিরিখেই বাজেটকে মূল্যায়ন করা সে কারণে যুক্তিসংগত হবে। সামষ্টিক অর্থনীতি কিছুটা স্থিতিশীল হচ্ছে, কিন্তু উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বিনিয়োগ চাঙ্গা করে কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে বেগবান করতে এই বাজেট সক্ষম হবে কি না, এটাই বিচার্য বিষয়। উল্লেখিত প্রেক্ষাপটে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে জনকল্যাণে এবং বিনিয়োগ-ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ ও প্রস্তাবের প্রতিফলন থাকলেও তা বণ্টনের ন্যায্যতা এবং বিনিয়োগে চাঞ্চল্য সৃষ্টির নিরিখে অর্থনীতির বর্তমান চাহিদার মাপকাঠিতে প্রস্তাবিত বাজেট ব্যতিক্রমী হয়েছে, সেটা বলা যাবে না। ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশের অভিন্ন কাঠামোতে নেওয়ার জন্য আইএমএফের একটা চাপ ছিল, যার প্রতিফলন বাজেটের বিভিন্ন প্রস্তাবে দেখা যায়। বেশ কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে; অনলাইন ব্যাবসায় কমিশনের ওপর ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে; গৃহস্থালি পণ্যের উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।এগুলো ভোক্তার ওপরই শেষ বিচারে বর্তাবে।
বিএনপি নেতা, সংসদ সদস্য প্রার্থী, বিশ্লেষক, ছাত্রদলের এক সময়ের কেন্দ্রীয় নেতা, সিলেট মহানগর বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক জননেতা মাহবুব চৌধুরী বলেন, বাজেটের প্রস্তাবগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বহুদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা এবং কাঠামোগত সংস্কারের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। বিশেষ করে রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থার দুর্বলতা, সরকারি ব্যয়ের অদক্ষতা এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা এই পুরনো ব্যাধিগুলো এবারও তেমনভাবে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে যেসব দাবি উঠে এসেছিল, তার মধ্যে বৈষম্য কমানো এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
এই দাবিগুলোর আলোকে এবারের বাজেটে সামান্য কিছু প্রতিফলন দেখা গেলেও তা খণ্ডিত ও সীমিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন নেই এবং তাতে যা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। একই সঙ্গে এই বরাদ্দ যথাযথভাবে কাজে লাগানোর জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং জবাবদিহির কাঠামো দরকার, তা এখনো অনুপস্থিত। রেমিট্যান্স ছাড়া প্রায় সব অর্থনৈতিক সূচকই দুর্বল। কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না, বিনিয়োগে নেই আস্থা। আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতিও অনুকূল নয়। সাধারণ মানুষের আয় বাড়ছে না, অথচ ব্যয় লাগামহীন। দেশের ৮০ শতাংশ সম্পদ মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের হাতে। ফলে প্রবৃদ্ধির সুফলও পৌঁছায় না সবার কাছে। আর এখন তো সেই প্রবৃদ্ধিও নিম্নমুখী।জীবিকার নিরাপত্তা, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, সুশাসন, কর্মসংস্থান ও নাগরিক সুবিধা, সংযমী ব্যয়, কাঠামোগত সংস্কার এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, বাস্তবায়ন কৌশল ছিল খুবই সাধারণ ও পুরোনো ধারার, বিনিয়োগে গতি আনতে বা সরাসরি কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হয় এ ধরনের কোনো আলাদা উদ্যোগও আমি দেখছি না।দেশে বহুমাত্রিক সংস্কার দরকার। রাজনীতি অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। আবার অর্থনীতি রাজনীতিকে পরিশীলিত করে। আমরা সংস্কার সংস্কার করছি। কিন্তুু এখনও কোনো সংস্কারের দেখা পেলাম না। কতগুলো সংস্কার আছে, সেগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক দলের কোনো বিরোধ নেই, চাইলেই অসংখ্য সংস্কার করা যায়। এখন পর্যন্ত কোনো সংস্কার আমার চোখে পড়েনি।অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্বে থাকায় বাজেটের গাণিতিক হিসাব ছাড়াও কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের সুযোগ ছিল।
অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট এসেছে একটি পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কিছুটা হলেও এখনও দুর্বল। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৫.৫ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরের ৪ শতাংশের চেয়ে ভালো। তবে আইএমএফের ৬.৫ শতাংশ প্রত্যাশার চেয়ে অনেকটাই কম। মে মাসে ৯.০৫ শতাংশ থাকা মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ধরা হয়েছে, যা অনেকাংশেই নির্ভর করছে বৈশ্বিক পণ্যমূল্য ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর। বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অনেকটাই নির্ভর করবে অর্থায়নের টেকসই কৌশলের ওপর, যেখানে দেশি-বিদেশি উভয় দিকেই রয়েছে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে বিদ্যমান করদাতাদের চাপে না ফেলে। ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে জরুরি বিনিয়োগ থেকে পিছিয়ে আসাও চলবে না। আবার সামাজিক সেবা দিতে গিয়ে অবকাঠামো উন্নয়নকেও উপেক্ষা করা যাবে না। এসব পরস্পরবিরোধী অবস্থার মাঝে দাঁড়িয়ে বাজেটটি বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তনের তুলনায় সতর্ক পদক্ষেপের দিকে মনোযোগ দিয়েছে। অর্থনৈতিক সংস্কারের পথে কাঠামোগত বাধা রয়েছে। যেমন করনীতি ও প্রশাসনের বিভাজন প্রচেষ্টা প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। কর ব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশন এগোচ্ছে ধীরগতিতে। অটোমেশন চালু হলে রাজস্ব সংগ্রহ সহজ ও দুর্নীতি কমে। কিন্তু প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও দক্ষতার অভাবে রাজস্ব ফাঁকির পথ খোলা রয়ে গেছে। এলডিসি থেকে উত্তরণ সামনে রেখে শুল্ক কাঠামো পুনর্বিন্যাসের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ ও জটিল হবে। বাংলাদেশের রাজস্ব সংস্কার অনেক দিন ধরেই প্রাতিষ্ঠানিক জড়তা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও প্রভাবশালী অর্থনৈতিক মহলের প্রতিরোধের মুখে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে নতুন অর্থবছরের বাজেট এক পরিচিত দ্বৈত বাস্তবতা তুলে ধরছে। উচ্চাভিলাষী রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ও ব্যয় পরিকল্পনার পেছনে রয়েছে এক গভীর সংস্কার-অপ্রত্যাশী প্রশাসনিক কাঠামো। কাঠামোগত পরিবর্তনের দিকে যেতে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা সীমিত। তাই রাজস্ব প্রশাসনে বড় ধরনের পরিবর্তন না এলে এই বাজেট কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক অগ্রগতি এনে দিতে পারবে না।
বিজিএমইএ এর প্রশাসক জনাব আনোয়ার হোসেন বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের ভিন্ন বাস্তবতায় বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয় শীর্ষক ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রস্তাবনা করা হয়েছে। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ শিল্পের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছেন। ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেটে লক্ষ্যবিলাষী ধারণা থেকে সরে এসে সামগ্রিক উন্নয়ন— বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুশাসন, নাগরিক সুবিধা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পাশাপাশি চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তোরণ প্রভৃতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।