
স্টাফ রিপোর্ট।
অনেক দিন ধরেই বিনিয়োগে মন্দা চলছে। এর সঙ্গে নতুন করে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি দেশের বেসরকারি খাতের প্রতিযোগিতা-সক্ষমতাকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। মূলধন ঘাটতির কারণে বিদ্যমান ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে ব্যবসা সম্প্রসারণ বা নতুন বিনিয়োগ বেশির ভাগ ব্যবসায়ীর অগ্রাধিকার তালিকায় নেই। অর্থনীতির এমন পরিস্থিতিতে বিপর্যস্ত শিল্প খাতকে টেনে তুলতে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে দেশীয় শিল্পের সুরক্ষার জোর দাবি উঠেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আগামী ২ জুন টেলিভিশনে নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবেন। পরে তা উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে পাস হবে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের এটি হবে প্রথম বাজেট। জানা গেছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটটি হতে যাচ্ছে সংকোচনমূলক বাজেট। বাজেটের আকার হবে সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানটি থেকে আগামী বাজেটের মূল আকার সাত হাজার কোটি টাকা কমবে, যা অতীতে দেশে আর কখনো এমনটি দেখা যায়নি।
দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, যা ৯-১০ শতাংশের ঘরে থাকছে। নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা থাকবে। আগামী অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হারের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৫.৫ শতাংশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আগামী অর্থবছরে পাঁচ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হতে পারে, যা চলতি বাজেটে ছিল চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার দুই লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এরই মধ্যে চূড়ান্ত করেছে পরিকল্পনা কমিশন।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘নানা কারণে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের নতুন বাজেট ছোট করতে হচ্ছে। সরকার বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট করতে চায়, মুখরোচক কিছু করতে চায় না। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে ব্যবসায়ীদের জন্য প্রণোদনা কমানোর কথা। তিনি বলেন, ‘যৌক্তিক কর ব্যবসায়ীদেরও দিতে হবে। সারা জীবন প্রণোদনা দেওয়া সম্ভব নয়। আগামী অর্থবছরের বাজেটে প্রণোদনা কমানো হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘গ্যাস ও ঋণের সুদের হার বৃদ্ধির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের ফলে দেশের শিল্প খাত এরই মধ্যে চাপে আছে। এই প্রেক্ষাপটে হঠাৎ করে কর রেয়াত প্রত্যাহার করলে বিশেষ করে এসএমই ও রপ্তানিমুখী খাতগুলোর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। বরং রেয়াতগুলোকে খাতভিত্তিক ও কার্যকারিতা অনুযায়ী পুনর্গঠন করা উচিত, যাতে সম্ভাবনাময় শিল্পগুলো প্রযুক্তি, উৎপাদনশীলতা ও রপ্তানিতে এগিয়ে যেতে পারে।
বিএনপি নেতা, সংসদ সদস্য প্রার্থী, বিশ্লেষক, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রাত্তন কেন্দ্রীয় নেতা, সিলেট মহানগর বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক জননেতা মাহবুব চৌধুরী বলেন, অর্থনীতিরও বেশির ভাগ সূচক নিয়েই বর্তমানে দুশ্চিন্তা। অর্থনীতির এই সংকটময় সময়ে বিনিয়োগ বাড়ানো না গেলে নতুন কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে, বাড়বে বেকারের সংখ্যা। দেশের ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে সহায়তা সম্প্রসারণ করে এই খাতকে আরো এগিয়ে নিতে হবে। কাঁচামালের ওপর শুল্ক ও ভ্যাট হ্রাস করে উৎপাদন ব্যয় কমানো, দেশীয় পণ্যের জন্য প্রণোদনা নিশ্চিত করা এবং এসএমই খাতে আলাদা বরাদ্দ দেওয়া উচিত। একের পর এক সংকট-অভিঘাতে গতিহীন ব্যবসা-বাণিজ্য। নানামুখী চাপে অস্বস্তিতে ব্যবসায়ীরা। না পারছেন ব্যবসা-উদ্যোগে আস্থা ফেরাতে, না পাচ্ছেন অনুকূল পরিবেশ।আমদানি, উৎপাদন, বিপণনে কোনোভাবে স্বস্তি মিলছে না, স্বস্তি চান ব্যবসায়ীরা। বৈশ্বিক শুল্কযুদ্ধ রপ্তানি বাজারেও নানা অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। আর জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়লে ব্যবসা-বাণিজ্য তথা সামগ্রিক অর্থনীতিতে সংকট আরো গভীর হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।টানাটানির বাজেটে অর্থনীতির ভারসাম্য বজায় রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা করা আর কর্মসংস্থান বাড়ানোই মূল চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করেন বিএনপির এই নেতা।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, বর্তমানে বেসরকারি খাত বহুমুখী চাপে রয়েছে। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, জ্বালানি খাতে অস্থিতিশীলতা এবং ঋণের উচ্চ সুদহারের কারণে ব্যবসার ব্যয় বহুলাংশে বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় শিল্প খাতে বিদ্যমান কর রেয়াত ও ভর্তুকি হঠাৎ করে তুলে নেওয়া হলে অনেক স্থানীয় শিল্প, বিশেষত এসএমই ও নবীন উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে। যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক আরোপের মতো বৈশ্বিক ঝুঁকি আমাদের রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতা আরো কঠিন করে তুলছে। স্থানীয় শিল্পের বিকাশে বাজেটে কিছু বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন ডিসিসিআই সভাপতি।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং অভ্যন্তরীণ চাপের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী বাজেট সম্পর্কে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে অংশীদারদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। বাজেটের মূল লক্ষ্য হবে ব্যবসা-বাণিজ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে ধারাবাহিক নীতিগত সহায়তা প্রদান। বিনিয়োগ বাড়াতে এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে হলে সুদের হার কমানো উচিত। আসন্ন বাজেটটি বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বান্ধবভাবে তৈরি হবে বলে আশা করি।
ব্যবসার পরিবেশের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা বলে জানিয়েছে বাংলাদেশে কাজ করা জাপানি কম্পানিগুলো। এ ছাড়া সরকারের অস্পষ্ট নীতি ব্যবস্থাপনা, বৈদ্যুতিক অবকাঠামোর ঘাটতি, আইনের অস্পষ্টতা ও জটিলতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও প্রধান ঝুঁকি বলে মনে করে তারা। জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জরিপে আরো বলা হয়, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের ব্যাবসায়িক আস্থা সূচক ৪১.৮ থেকে কমে ৬.৬ শতাংশে নেমে আসে। তবে ২০২৫ সালে এ সূচক বৃদ্ধি পেয়ে ৪৩.৫ শতাংশ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।